শিরোনাম

প্রতি মুহূর্তে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মৎস্য চাষের সাথে জড়িত আশাশুনির ও শ্যামনগরের মানুষ - Chief TV - চিফ টিভি

প্রতি মুহূর্তে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মৎস্য চাষের সাথে জড়িত আশাশুনির ও শ্যামনগরের মানুষ  - Chief TV - চিফ টিভি

আজগার আলী, বিশেষ প্রতিনিধি, সাতক্ষীরাঃ

ভালো কিছুর আশায় একবুক আশা নিয়ে প্রতি বছর নতুন করে শুরু করেন চিংড়ি চাষ। কিন্তু বিধি বাম নদী ভাঙন থেকে শুরু করে চিরশত্রু ভাইরাস তো লেগেই আছে। আশাশুনি-শ্যামনগরের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্য যেন নির্ভর করে চিংড়ি চাষের উপর। দু-বেলা দু’মুঠো ভাতের আশায় নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে উপকূলবাসী। সফলতা যেখানে অনিশ্চিত সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন হাজারো মৎস্য শ্রমিক। প্রতি মুহূর্তে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মৎস্য চাষের সাথে জড়িয়ে নিচ্ছেন আশাশুনি-শ্যামনগরের মানুষ। সকলের অবস্থা যেন ঘোলা জলে মাছ শিকার।

উপকূলের লোনা পানি বাগদা চিংড়ির আধার। ভূমির অভ্যন্তরে যতদূর পর্যন্ত সমুদ্রের পানি প্রবেশ করে তাকে উপকূলীয় অঞ্চল বলে ধরা হয়। চিংড়ি প্রধানত লোনা বা আংশিক লোনা পানিতে ভালো হয়। হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে লোনাপানি তুলে চিংড়ি চাষ করেন উপকূলের চাষিরা। বাগদা চিংড়ি আর লোনাপানি যেন একসূত্রে গাঁথা। উপকুলের মানুষ দু’টাকা বেশি আয়ের আশায় লোনা জলে ভাগ্য খুঁজছেন। তবে এবার সেই সূত্রে খানিকটা ছেদ পড়েছে। প্রচন্ড তাপদাহ ও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আশঙ্কাজনক হারে মারা যাচ্ছে বাগদা চিংড়ি, হরিণা চিংড়ি এবং চাকা চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ। উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে চিংড়ি চাষে এমন বিপর্যয়ে জেলার অধিকাংশ চাষিরা পড়েছেন ক্ষতির মুখে।

চিংড়িকে আমাদের দেশে সাদা সোনা বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর সাতক্ষীরাকে ধরা হয় চিংড়ি চাষের স্বর্গ রাজ্য হিসেবে। দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে চিংড়ির চাহিদা ও বাজারদর বেশি থাকায় চিংড়ি চাষ লাভজনক। চিংড়ির পোনা সহজলভ্য, অল্প বিনিয়োগেই চিংড়ির খামার গড়ে তোলা যায় এবং সারা বছর চিংড়ি চাষ করা যায়। আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে বর্তমানে হেক্টর প্রতি ফলন ৪৫০ কেজি থেকে ৬০০ কেজিতে উন্নীত করা সম্ভব। আমাদের দেশে মাছ রপ্তানি আয়ের শতকরা ৫৮ ভাগ আসে চিংড়ি থেকে। চিংড়ির চাষ করে চাষির আয় ও কর্মসংস্থান ৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষের বিকল্প খুঁজে পাওয়া দায় কিন্তু এতো অনিশ্চয়তার মধ্য থেকে চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যসূত্রে, সাতক্ষীরা জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে ৫৯ হাজার লবণ পানির ঘের রয়েছে। এর আয়তন প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর। আর জেলার মোট উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় এবং বাকি ১০ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ হয়। তবে এ বছর প্রায় ঘেরেই বাগদা চিংড়ি মাছ মারা যাচ্ছে। এতে জেলার চাষিরা আর্থিকভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, ভাইরাসের পাশাপাশি প্রচন্ড তাপদাহ, পর্যাপ্ত পানির অভাব, অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে ঘেরের বাগদা চিংড়ি, হরিনা চিংড়ি, চাকা চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ মরছে। তার উপর চাষিরা মৎস্য বিভাগের পরামর্শ গ্রহণ না করায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি মৎস্য বিভাগের।

আশাশুনি ও শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, অনাবৃষ্টি আর প্রখর রোদে মাছের ঘের আর ছোট-বড় জলাশয় গুলোতে পানি খুবই কম ছিল। অত্যাধিক তাপে এই অল্প পানি উত্তপ্ত হয়ে ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যাচ্ছে চিংড়ি মাছসহ অন্যান্য মাছ। যেগুলো মাছ বেঁচে আছে তাও রোগাক্রান্ত। এই কয়দিন বৃষ্টি হয়েছে তাই এবার সাদা মাছ ছেড়ে দেবো।

স্থানীয় মৎস্য চাষিরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর তাপমাত্রা অনেক বেশি। এপ্রিল মাস থেকে গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপে পুড়ছে গোটা জেলা। হয়নি কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। ফলে লবণ পানির ঘেরগুলোতে লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে গত দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ঘেরের চিংড়ি মাছে মড়ক লেগেছে। এতে চাষিরা নতুন করে আর চিংড়ি পোনা ছাড়ছেন না। সবার মাঝে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

আশাশুনির চিংড়ি চাষি হানিফ বলেন, এ বছর আমি ৫ বিঘা জমিতে বাগদার পোনা ছেড়েছিলাম। প্রচুর মাছ ফুটেছিল কিন্তু বিক্রির উপযুক্ত হয়ে ওঠার আগেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরতে শুরু করেছে। তবে হঠাৎ করে গেল দুই সপ্তাহ আগে থেকে ঘেরে মাছ মরে ভেসে উঠছে। আর যেসব জীবিত মাছ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর শরীরও দুর্বল। মাছ লালচে হয়ে যাচ্ছে।

শ্যামনগর উপজেলার চিংড়ি চাষি হাসানুজ্জামান বলেন, আমি অনার্স পাশ করে চাকরির পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ৯ বিঘা জমির চিংড়ি চাষের ঘের দেখা-শোনা করি। কিন্তু এবার প্রচন্ড তাপমাত্রা ও ভাইরাসের কারণে লাভ করতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে। বাগদা চিংড়ি মাছ মরে লাল হয়ে যাচ্ছে। আর এই মরা মাছ পচে ঘের পরিবেশ নষ্ট করছে যেটা অন্যান্য মাছের জন্য ক্ষতিকর।

সাতক্ষীরা মৎস্য কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, দেশে বাগদা ও গলদা চিংড়ির এক তৃতীয়াংশ উৎপাদিত হয় সাতক্ষীরা জেলায়। তবে এখানে মাছের ঘের সনাতন পদ্ধতির। অধিকাংশ ঘেরে পানির গভীরতা দেড় থেকে দুই ফুটের বেশি নয়। 

এজন্য গ্রীষ্মকালীন সময়ে ঘেরে পানির স্বল্পতা, অস্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে মাছ মরার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য, ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধিসহ ঘের প্রস্তুত ও ভাইরাসমুক্ত পোনা ছাড়তে চাষিদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বাগদা চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর লবণসহিষ্ণু মাত্রা হলো সর্বোচ্চ ২৫ পার্টস পার থাউস্যান্ড (পিপিটি)। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি চিংড়ি চাষের জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন তা ঘেরগুলোতে নেই। এ কারণে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে গরমের কারণে বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই